অভিশপ্ত এক জনপদ বোবারথল
অবহেলিত
'বোবারথল' শুধু অভিশপ্ত জনপদই নয়, সেখানে ছড়িয়ে আছে শায়েস্তা খাঁ আমলের নানা সুখ-শান্তির সুবাতাস।
অবরুদ্ধ এ জনপদে মৌসুমে এক টাকায় একটি কাঁঠাল কেনা যায়। ১০০টি আনারসের দাম ৫০-৬০
টাকা। আর এক কুড়ি কমলার দাম বড়জোর পাঁচ টাকা। টাটকা শাকসবজির দামও অত্যন্ত কম।
কৃষকরা জানান, এখানে উৎপাদিত পণ্য শহরে নিয়ে গেলে ভালো
দাম পাওয়া যায়। কিন্তু নিয়ে যাওয়াটাই বড় ঝামেলা। বারুয়াদের (বাহক) মাধ্যমে এক মণ
করে পণ্য পাঠাতে হলে সময় যেমন যথেষ্ট লাগে, তেমনি
বারুয়াদের খরচও দিতে হয় প্রতি ট্রিপে দেড় শ টাকা করে। ফলে কেউ আর নগদ টাকা খরচের
ঝুটঝামেলায় পা বাড়ায় না।
পাহাড়-টিলার
সীমাহীন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তবেই বোবারথল জনপদে পেঁৗছানো সম্ভব হয়। সেখানে আনারস, কাঁঠাল, কমলা, বিভিন্ন
জাতের লেবু আর শাকসবজি ব্যাপকভাবে উৎপন্ন হতে দেখা যায়। এসব ফল-ফসল শহর এলাকায়
নিতে না পারায় ন্যায্যমূল্য পান না কৃষকরা। মৌসুমে প্রতি বৃহস্পতি ও সোমবার
বোবারথলের হাটে হাজার হাজার কাঁঠাল-আনারস-কমলার ছড়াছড়ি থাকে। অথচ ক্রেতা পাওয়া যায়
না। ফলে কষ্ট করে বয়ে আনা ফল-ফসল সন্ধ্যা অবধি রেখে কৃষকরা পাশের ছড়ায় ফেলে দিয়ে
বাড়ি ফিরে যান।
শুধু
যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে অবরুদ্ধ এ জনপদের সম্পদ। প্রকৃতির নানা আশীর্বাদের
পাশাপাশি বোবারথলের খাসিয়াপুঞ্জি-বেষ্টিত গান্ধাই টিলার বিরাট এলাকাজুড়ে কয়লার খনি
আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়েকটি টিলা-পাহাড়ের ওপর-নিচ ও ভেতরের সর্বত্র কেবল কয়লা আর কয়লা।
স্থানীয় বাসিন্দারা দা, কুড়াল, কোদালের
সাহায্যে সেসব কয়লা তুলে রোদে শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। বোবারথলবাসীর
আশা ছিল, কয়লার খনি উত্তোলনে সরকার উদ্যোগ নিলেই সে
সুযোগে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থা অজ্ঞাত কারণে খনিটি
থেকে আজ পর্যন্ত কয়লা উত্তোলনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বৃহত্তর
সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সীমান্তবর্তী জনপদ 'বোবারথল'। বোবারথল রীতিমতো আজব এক ভুবন। যে
পথেই রওনা দেওয়া হোক না কেন, সেখানে যেতে আট কিলোমিটারের
চড়াই-উতরাই, বন্ধুর পাহাড়ি রাস্তা পেরোতেই হবে। ঝোপঝাড়ের
মধ্যে ডালপালার খোঁচা খেয়ে, কাঁটা ফুটিয়ে একবার ৩০০ ফুট
নিচে নামা, আবার পরক্ষণেই পাহাড় খামচে ধরে ধরে ৪০০ ফুট
উঁচুতে ওঠা। ১২-১৩ বার এমন ওঠানামার পর যে কারোরই পা অবশ হয়ে যায়। হারিয়ে যায় চলার
শক্তি। এর পরও আছে পদে পদে বিপদ। ঝোপ-জঙ্গলের অাঁকাবাঁকা পথে সাপ-খোপ, পোকাকামড়, বনবেড়াল, রাম
কুকুর, ভালুুক, চিতাবাঘসহ হিংস্র
প্রাণীর আনাগোনা রয়েছে। গত শতকের পঞ্চাশ, ষাটের দশকেও
বোবারথল ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। ঘন ঝোপ-অরণ্যে ঘেরা দুর্গম স্থানটিতে কারও যাতায়াত
ছিল না। হিংস্র বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত ছিল বোবারথলসহ আশপাশের শতাধিক
বর্গ কিলোমিটার এলাকা। 'আদম সন্তান' বলতে ছিল ষাটঘরির সুউচ্চ টিলার মাথায় কিছু ইপিআর সদস্যের অবস্থান।
তৎকালীন পাকিস্তান ইপিআর ক্যাম্পটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হতো কেবল হেলিকপ্টারের
সাহায্যে।
১৯৬৪
সালে ভারতে সংঘটিত দাঙ্গায় সর্বস্বহারা মোহাজেরিনরা সীমান্ত পেরিয়ে দুর্গম অরণ্য
জনপদ বোবারথলে আশ্রয় নেন। কিন্তু দাঙ্গা শেষে তারা আর ফিরে যেতে পারেননি নিজ
বাসভূমে। বোবারথলেই শুরু হয় তাদের নির্বাসিত জীবন। এর পর পেরিয়ে গেছে তিনটি যুগ।
তবু নির্বাসিত জীবনের ক্ষেত্রে তেমন তারতম্য ঘটেনি। আজও এখানকার বাসিন্দারা পাননি
সভ্যতার আলো, আধুনিকতার ছোঁয়া। যোগযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণেই
অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন বোবারথলবাসী। ছোটলেখায় চা-বাগানের কারণে সরাসরি রাস্তা
নির্মাণ করতে পারেনি এলজিইডি। তাই উন্নয়ন বরাদ্দের টাকা ফেরত চলে গেছে। এখন ইউনিয়ন
পরিষদ ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের বরাদ্দ থেকে কিছু টাকা ব্যয় করে একটি রাস্তা বানানোর
চেষ্টা চলছে। কিন্তু রাস্তাটির মধ্যবর্তী স্থানে বড় একটি পাহাড়ের অবস্থান থাকায়
সেখানেই আটকে গেছে নির্মাণকাজ।
গ্রাম্য
ওঝা-কবিরাজদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল এখানকার জনগোষ্ঠী আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার
সঙ্গে মোটেও পরিচিত নয়। বেশির ভাগ নারী-পুরুষ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বোঝেন না।
জানেন না অপুষ্টি কাকে বলে। রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত রোগীকে জন্ডিসের ওষুধ খাওয়ানো
হয়। শ্বাসকষ্টের রোগীকে দেওয়া হয় ভূত ছাড়ানোর ঝাড়ফুঁক। সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রেও
সেখানে আধুনিক কোনো পদ্ধতির সুযোগ পান না তারা। ফলে বোবারথলে সন্তান প্রসবকালে
করুণ মৃত্যু ঘটেছে মমতাজ বেগমসহ আরও অনেকের। ইদানীং স্বাস্থ্য-সচেতনতা বাড়ানোর
পাশাপাশি বোবারথলের ১০টি গ্রামের জন্য চারটি ইপিআই সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।
ইপিআই কর্মী নাজমা বেগম এখন বাড়ি যাচ্ছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন
রোগীদের। শিশুদের টিকাদান, অপুষ্টি রোধ ইত্যাদি ব্যাপারে
সচেতনতা সৃষ্টিরও কার্যক্রম চলছে। কিন্তু ময়লা-আবর্জনাপূর্ণ পানি ব্যবহার ও পানের
ফলে পেটের পীড়াসহ নানা রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। পাহাড়ি মশার কামড়ে ছড়িয়ে পড়ছে
ম্যালেরিয়া। চর্মরোগ, অন্ধত্ব, আমাশয়,
ডায়রিয়াসহ কঠিন ব্যাধিগুলো নিরাময়ে চিকিৎসা ও ওষুধপথ্য কিছুই নেই
বোবারথলে। আছে শুধু সিরাজ কবিরাজের সর্বরোগের ধন্বন্তরী তাবিজ, পানিপড়া। সাপে কাটলেও সিরাজ কবিরাজ! মাথা ধরলেও সিরাজ কবিরাজ!
সমগ্র
এলাকায় বিনোদন বা খেলাধুলার বিন্দুমাত্র উপকরণ নেই। বোবারথল বাজারে আছিরুদ্দিনের
চায়ের দোকানে এবং ষাটঘরি গ্রামে আবদুর রহমানের দোকানে দুটি সাদা-কালো টিভি আছে।
ব্যাটারির সাহায্যে চলে। সেখানে টাকার বিনিময়ে মানুষজন নানা অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ
পায়। টিভি দেখার রেট হরেক রকমের। বাংলা সিনেমা দেখার রেট জনপ্রতি তিন টাকা, সাপ্তাহিক নাটক দুই টাকা, সিরিজ নাটক এক টাকা,
ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তিন টাকা, ৮টার
বাংলা সংবাদ এক টাকা, অন্যান্য অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে
চাহিদা অনুযায়ী টিকিটের হার বসানো হয়। আর খেলাধুলা বলতে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয় মাঠে ছাত্রছাত্রীদের বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানকেই বোঝানো হয়। সমগ্র বোবারথলে
আর কোনো ধরনের খেলাধুলা বা চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। মাঝেমধ্যে
হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, লাটিম
খেলায় মত্ত থাকতে দেখা যায় শিশু-কিশোরদের। যুবসমাজ উদয়াস্ত পরিশ্রমের পর অবসর
সময়টা অলসভাবে কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় দেখে না। আধুনিক সভ্যতার যুগেও শিক্ষাবঞ্চিত
হয়ে আছেন বোবারথলের বাসিন্দারা। ১০টি গ্রাম-পাড়া ঘুরেও একজন ডিগ্রি পাস
শিক্ষার্থীর সন্ধানে মিলল না। সমগ্র বোবারথল জনপদের প্রথম শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে
ধরা হয় এম এ শহীদকে। উত্তর ষাটঘরি গ্রামের এম এ শহীদ বিয়ানীবাজারে লজিং থেকে ১৯৮৪
সালে এইচএসসি পাস করায় বোবারথল জনপদে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আয়োজন হয় নানা
আনন্দ-অনুষ্ঠানের। বোবারথলে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। কিন্তু সেখানে
শুরু থেকেই শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণের সংকট। শিক্ষার্থীর সংখ্যাও হাতে গোনা। কিছু
ছেলেমেয়ে স্কুলে যাতায়াত করলেও নাম স্বাক্ষর শেখার পর অনেকেই আর স্কুলে যাওয়ার
প্রয়োজন বোধ করেনি। নতুন প্রজন্মের শতকরা ৮৫ ভাগ ছেলেমেয়ে বেড়ে উঠছে অক্ষরজ্ঞান না
নিয়েই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায়
বোবারথলে এক কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি দ্বিতল হাইস্কুল ভবন নির্মাণ করা হয়।
কিন্তু সেখানেও শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থী গড়ে তোলা যাচ্ছে না। দুর্গম এলাকা হওয়ায়
বাইরে থেকে কোনো শিক্ষক সেখানে যাতায়াত করতে রাজি হন না বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
বোবারথলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে 'বারুয়া' নামে এক পেশাদার শ্রেণীর বসবাস আছে। তারা কঠোর পরিশ্রমী হিসেবে পরিচিত।
অনেকেই তাদের 'পাহাড়িয়া দৈত্য' বলে
জানে। মূলত বারুয়ারা হচ্ছে বোঝা বহনকারী দল। দুর্গম পাহাড়ি ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে
তারা ভারী বোঝা বহন করে মাইলের পর মাইল ছুটে যায়। আধুনিকতার ছোঁয়াবিহীন বোবারথলে
যেটুকু সভ্যতার সংস্পর্শ লেগেছে, এর যোগসূত্র হিসেবে
বারুয়াদের রয়েছে বিরাট অবদান। কাঁধে ধনুকের মতো ত্যাড়াব্যাঁকা বাহুকের দুই মাথায়
বোঝা বহন করে তারা শহরের দিকে ছুটে যায়। আবার শহুরে পণ্যসামগ্রী নিয়ে একই কায়দায়
বারুয়ারা ফিরে আসে বোবারথলে। বিনিময়ে তারা একবারের জন্য ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত
ভাড়া গ্রহণ করে। পাহাড়-টিলা বেয়ে, অরণ্য পথে সারিবদ্ধভাবে
চলাচল করে বারুয়ারা। রাতে থাকে তাদের হাতে হাতে প্রজ্বলিত মশাল। 'অ্যাই, হেই, হেইও,
হেই...' ইত্যাদি শব্দে কাঁপন তুলে পথ
চলে তারা। বোবারথলে সব মিলিয়ে শ দুয়েক পরিবার বারুয়া পেশার ওপর ভিত্তি করে
জীবন-জীবিকা চালায়। ব্যবসায়ী মহলের কাছে দারুণ কদর তাদের। গুরুতর অসুস্থ রোগীকে
মাচানে করে শহরের হাসপাতালে নিতেও বারুয়াদের ডাক পড়ে।
সুত্র- বাংলাদেশ প্রতিদিন।
No comments:
Post a Comment