রয়েল বেঙ্গল টাইগার কমেছে ৬৯ শতাংশ
গত চার বছরে রয়েল বেঙ্গল টাইগার কমেছে ৬৯ শতাংশ। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই প্রাণী সংরক্ষণে জরুরি উদ্যোগ না নিলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সুন্দরবন থেকে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বন বিভাগ ও বাংলাদেশ বন্য প্রাণী ট্রাস্টের (ডব্লিউটিবি) এক জরিপ প্রতিবেদনে এ আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘বাঘের তুলনামূলক সংখ্যা’ (বাংলাদেশ সুন্দরবন রিলেটিভ টাইগার অ্যাবানডেন্স সার্ভে ২০১২) শীর্ষক ওই জরিপে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১২ সালের সর্বশেষ জরিপে বাঘ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মূলত চোরা শিকারিদের দায়ী করা হয়েছে।
গত তিন-চার বছরে চোরা শিকারিদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় বাঘের সংখ্যা কমেছে বলে জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০১৭ সালের মধ্যে সুন্দরবন থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। চীনসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ভেষজ ওষুধ হিসেবে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার বাড়ছে। সুন্দরবনের বাঘ ওই চোরা শিকারিদের নজরে পড়েছে। দুটি সংঘবদ্ধ বাঘ চোরা শিকারি দল সুন্দরবনে সক্রিয় আছে বলে সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জরিপে সুন্দরবন থেকে বাঘ নিঃশেষ হতে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণের সংখ্যা কমে যাওয়াকেও দায়ী করা হয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ হাজার হরিণ শিকার করা হচ্ছে। বনে হরিণের সংকট হওয়ায় বাঘ নিয়মিতভাবে সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামগুলো থেকে গরু, ছাগল, কুকুর, মুরগিসহ বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণী ধরে খাচ্ছে। আর এতে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ নানা ধরনের গবাদিপশুবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েও বাঘ মারা যাচ্ছে।
এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে সিডর ও আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে বাঘের সংখ্যা কমেছে। বাঘের সংখ্যা কমার সর্বশেষ কারণ হিসেবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বন উজাড়কে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রাণী-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিডর ও আইলার আঘাত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া বাঘের জন্য যতটা না হুমকি, তার চেয়ে বড় হুমকি মানুষের তৎপরতা ও চোরা শিকারি নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের ব্যর্থতা।
তবে নিজের সমীক্ষা (২০১০ ও ২০১১) নিয়েই আপত্তি তুলেছে বন বিভাগ। খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক আকবর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাঘের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার যে তথ্য সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, তা সঠিক। কিন্তু পরের বছরগুলোতে সমীক্ষাটি সঠিকভাবে হয়নি। তাই আগামী জানুয়ারিতে আরেকটি সমীক্ষা করে বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।
প্রতিবছর এ ধরনের জরিপ করা হয়। এ বছর ৪৮ জনের ছয়টি দল অংশ নেয়। এর মধ্যে বন বিভাগের ১৮ জন, ডব্লিউটিবির আটজন ও সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামবাসীর সমন্বয়ে গঠিত বন সংরক্ষক দলের সাতজন এতে অংশ নেন।
ডব্লিউটিবির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বন বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে সমীক্ষাটি করা হয়েছে। বন বিভাগ থেকে সমীক্ষাটি সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলো তোলা হচ্ছে, তাকে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে বাঘের সংখ্যা এক লাখ থেকে তিন হাজারে নেমে এসেছে।
বঙ্গবন্ধু জীববৈচিত্র্য পদকজয়ী আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, বাঘ চোরাচালানকারী আন্তর্জাতিক চক্র সুন্দরবনসহ বিশ্বের বেশির ভাগ বনে সক্রিয় রয়েছে। এই সমীক্ষায় এদের তৎপরতার কারণে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার বিষয়টি চিহ্নিত হয়েছে। ফলে সরকারের সামনে এই চক্রকে সমূলে উৎপাটন করে বাঘ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হলো।
একজনের হাতেই ২৭ বাঘ শিকার: ২০১১ সালে সুন্দরবনের বাগেরহাট এলাকার শরণখোলা রেঞ্জে এক চোরা শিকারি তিনটি বাঘের চামড়া, চারটি বাঘের খুলিসহ গ্রেপ্তার হন। পরে ডিসেম্বরে আরেকজন চোরা শিকারি একটি বাঘের চামড়াসহ ধরা পড়েন এবং তিনি আরও দুটি বাঘ মেরেছেন বলেও স্বীকার করেন। চলতি বছরের জুনে রাজধানীর শ্যামলীর এক বাসা থেকে তিনটি বাঘের বাচ্চা আটক করে র্যাব।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে জরিপকারী দলকে একজন জেলে জানিয়েছিলেন, তিনি একটি নৌকায় তিনটি বাঘের কঙ্কাল ও চামড়া নিয়ে যেতে দেখেছেন। একজন পেশাদার চোরা শিকারি জরিপকারী দলের কাছে স্বীকার করেন যে তিনি ২০১১-১২ সালের মধ্যে ২৭টি বাঘ হত্যা করেছেন।
বাঘের সংখ্যা কত: বন বিভাগ থেকে বলা হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০। সর্বশেষ ২০০৪ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী এ সংখ্যা ৪৪০। ২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক মনিরুল এইচ খানের তত্ত্বাবধানে ব্রিটিশ জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় ক্যামেরা-ফাঁদ পদ্ধতিতে জরিপ চালানো হয়। এতে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ২০০।
মনিরুল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সমীক্ষায় চোরা শিকারিদের যে তৎপরতার কথা বলা হয়েছে, তা আমাদের গবেষণা ও পর্যবেক্ষণেও দেখা গেছে।’ বাঘ কমে যাওয়ার হারকে আশঙ্কাজনক হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। তবে বাঘের সংখ্যা ৬৯ শতাংশ কমেছে কি না, তা নিশ্চিত করতে আরও অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করে একটি পূর্ণাঙ্গ বাঘশুমারি হতে হবে। কেননা, বাঘ বিলুপ্ত হলে সুন্দরবন রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। আর সুন্দরবন তো বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের সবচেয়ে বড় আধার। এই সুন্দরবন বুক দিয়ে দেশের উপকূলবাসীকে রক্ষা করে।
সুপারিশ: সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাঘ সংরক্ষণে ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাঘ শিকারি নির্মূলে সুন্দরবনে অতিরিক্ত টহল বাড়ানো, বন্য প্রাণী অপরাধ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি তথ্যকেন্দ্র স্থাপন, বাঘ ও হরিণ হত্যা প্রতিরোধে একটি টাস্কফোর্স গঠন, ভারত সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে বনে টহল বাড়ানো, বাঘ ও হরিণ হত্যায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানো, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বাঘ সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়ানো।
সুত্র- প্রথোম আল
No comments:
Post a Comment