সূর্যের বিস্ফোরণ
রোদের উৎস যে সূর্য সেটি কে না জানে। আর ভূগোল বইয়ের
কল্যাণে সবাই জান পৃথিবীর আহ্নিক গতি সম্পর্কে। আর এও আমাদের অজানা নয় যে, শুধু গতির
কারণেই আমরা দিন ও রাত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুভব করি। এ তথ্যগুলো না হয় প্রাকৃতিক
ভূগোল আমাদের জানিয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন যে টকটকে লাল একটি সূর্যকে আমরা পূর্বদিকে
উদয় হতে আর পশ্চিমে অস্ত যেতে দেখি সে সম্পর্কে কতটুকু জানি? আমরা তো শুধু দেখতে পাই
সূর্যের ঔজ্জ্বল্য আর টের পাই এর উত্তাপ। কিন্তু এই তাপ আর ঔজ্জ্বল্যই বা আসে কোথা
থেকে? কীভাবেই বা এসবের সৃষ্টি হয়? সূর্যের বুকের ভেতরই বা অনবরত কী ঘটে চলেছে? আবার
এও শোনা যাচ্ছে, এই সূর্যেই নাকি এক প্রবল বিস্ফোরণ ঘটতে চলেছে। একথা কি সত্যি? যদি
তাই হয় তবে এর পরিণামই বা কী হবে? এসব প্রশ্ন প্রায়ই আমাদের মনে ঘুরপাক খেয়ে চলে। কিন্তু
উত্তর হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অজানা। ফলে কৌতূহল বেড়েই চলে। তাই এসব প্রশ্নের উত্তর
খুঁজে পেতে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরা হলো। কিন্তু পড়লেই যে এ বিষয়ে সব কৌতূহলের
অবসান হবে, সে গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না। তবে এ সম্পর্কে কিছুটা আগ্রহ যে বাড়বে তাতে
সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
সূর্যের বুকে যে সর্বদা ঝড় বয়ে চলেছে তা আমরা কেউ
হয়তো জানি, আবার কেউ বা এ বিষয়ে কিছুই জানি না। তাই বলে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের মতো বলব
না যে, যারা জানেন তারা বলেন, আর যারা জানেন না তারা চুপটি করে শোনেন। যাই হোক, ঝড়ের
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এতদূর থেকে আমরা সে ঝড়ের কিছু টের পাই না। সেই ঝড় কখনো বা অতি প্রচণ্ড,
আবার কখনো বা হালকা ধরনের। প্রতি ১১ বছর পর পর তা কিন্তু তীব্র রূপ ধারণ করে। এ পৃথিবীতে
বসেই তার খানিকটা অাঁচ করা যায়। গতবছরও সৌরঝড় হয়েছিল এবং তা গোটা পৃথিবীতে তোলপাড়
ফেলে। এর ১১ বছর আগে ২০০০ সালেও ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এই ঝড় শেষবারের মতো
মারাত্মক আকার ও তীব্রতর রূপ ধারণ করেছিল তারও ১১ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে। এ ঝড়টি
এভাবে ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে করতে একদিন সূর্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলবে তাতে সন্দেহের
কোনো অবকাশ নেই। সৌরঝড়ের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে জানার আগে জানতে হবে সূর্যের সাতকাহন। সূর্য
আসলে মহাশূন্যের বুকে একটি থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বা তাপ পারমাণবিক চুলি্ল। এর
কেন্দ্রস্থলে অর্থাৎ যেখানে থার্মোনিউক্লিয়ার ফার্নেসে হাইড্রোজেন গলে হিলিয়ামে পরিণত
হচ্ছে সেখানকার তাপমাত্রার পরিমাণ আমাদের কল্পনার বাইরে। এ ছাড়া এক ভয়ঙ্কর অস্থিরতা
বা প্রচণ্ডরকমের ওলট-পালট সর্বদা ঘটে চলেছে সূর্যের বুকে। পৃথিবীতে যেমন বায়ুপ্রবাহ
রয়েছে তেমনই উত্তপ্ত গ্যাসের প্রচণ্ড গতির প্রবাহ সূর্যের আলোকমণ্ডল বা ফোটোস্ফেয়ারের
ওপর ও নিচে দুটি মেরু প্রদেশকে ঘিরেই পাক খাচ্ছে। গ্যাসের এ প্রবাহটি প্রায় ১৭ হাজার
মাইল চওড়া। গ্যাসের এ প্রবাহের গতির তারতম্যের কারণে চৌম্বকীয় উদ্গিরণ হয় যা বাইরের
দিকে বেরিয়ে এসে সৌরঝলক সৃষ্টি করে বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা। আরও একটি বিষয় রয়েছে।
সূর্যের দুটি মেরু ১১ বছর পর পর একেবারে উল্টে যায়। অর্থাৎ সে সময়ে কোনো সৌর কম্পাস
সূর্যের বুকে নেওয়া হলে কম্পাসের কাঁটা একদম ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাবে। অবশ্য সূর্যের দুই
মেরুর এভাবে দিক পরিবর্তনের আগে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি মারাত্মক। সেটি
হলো সূর্যের পৃষ্ঠদেশজুড়ে এক ধরনের চৌম্বকীয় স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয় এবং স্ফুলিঙ্গ থেকে
সূর্যের বুকে সময়ান্তরে চৌম্বকীয় ঝড় ওঠে। প্রতি ১১ বছর পর পর সূর্যের দুই মেরুর দিক
পরিবর্তনের সময়ে এ ঝড়ের তীব্রতা তুঙ্গে পেঁৗছে। এ সময়ে সূর্যপৃষ্ঠে বিশাল বিশাল গ্যাসীয়
পিণ্ডি জমতে থাকে, সৌরঝলক সৃষ্টি হয় আর বিপুল পরিমাণ গ্যাসের উদগিরণ ঘটে। ২০১১ এবং
২০০০ সালে ঠিক এমনটিই ঘটেছিল। সূর্যের বুকে নিয়ত প্রচণ্ড অস্থিরতার কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে
সৌরবায়ু। এটি হলো সূর্যের প্রভাময় ছটামণ্ডলের উগড়ে দেওয়া চুম্বকায়িত গ্যাসের প্রবাহ।
এ গ্যাসের তাপমাত্রা ১০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। এত উত্তপ্ত বলেই এতে হাইড্রোজেন
ও হিলিয়ামের অ্যাটম মিশ্রিত হয়ে প্লাজমায় রূপান্তরিত হয় যা কিনা মূলত নেগেটিভ চার্জযুক্ত
প্রোটিন দ্বারা গঠিত। এ সৌরবায়ু সূর্য থেকে উৎপন্ন হয়ে সৌরমণ্ডলের প্রান্ত অভিমুখে
প্রবাহিত হয়। এর গতিবেগ দাঁড়ায় ঘণ্টায় ১৬ লাখ কিলোমিটার। আসলে এটি হলো বেশ কয়েক লাখ
থেকে শুরু করে কয়েক কোটি টনের মতো পদার্থের একত্রিত সমাবেশ। কিন্তু ঘনত্ব খুব কম হওয়ায়
এগুলো প্রায়শই বায়বীয় আকার ধারণ করে যাকে এ ক্ষেত্রে আমরা শূন্য বলতে পারি। সৌরবায়ু
সৌরজগতের প্রান্তের দিকে যাওয়ার সময় মাঝপথে পৃথিবীর শরীরেও ঝাপটা দিয়ে যায়। তবে এটি
কিন্তু প্রথমেই সরাসরি পৃথিবীকে স্পর্শ করতে পারে না। কারণ পৃথিবীর চারপাশ ঘিরে রয়েছে
ম্যাগনেটোস্ফিয়ার বা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সীমানা। মোটরগাড়ির উইন্ডশিল্ড যেমন
বাতাসকে দুপাশে সরিয়ে দেয় ঠিক তেমনই পৃথিবীর দিকে ধাবমান সৌরবায়ুর বেশিরভাগ টিআই ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের
গায়ে ধাক্কা খেয়ে অপর পাশে সরে যায়। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, সৌরবায়ু মানেই অতি লঘু
ঘনত্বেব বস্তু কণিকা বা পার্টিকল। ম্যাগনেটোস্ফিয়ার এভাবে ওইসব বস্তু কণিকাকে অন্যদিকে
সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করে। কিন্তু এতসব কাণ্ডের পরও ট্রিলিয়ন চার্জযুক্ত পার্টিকল
ম্যাগনেটোস্পিয়ারের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর কিছু অংশ আটকে পড়ে পৃথিবীর চারপাশে একটি বিকিরণ
বলয় তৈরি করে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ব্যান এলেনের নাম অনুসারে একে ভ্যান এলেন বিকিরণ বলয়
বা র্যাডিয়েশন্স বোল্ড বলে উল্লেখ করা হয়। বাকি অংশ উত্তর ও দক্ষিণ মেরু দিয়ে পৃথিবীর
বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে যে শক্তি সৃষ্টি হয় তাতে এখানকার নাইট্রোজেন
ও অঙ্েিজনের অটমগুলো উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সেগুলো তখন রঙিন আলো বিকিরণ করে। এর ফলেই
সৃষ্টি হয় অরোরা বা মেরুপ্রভা।
সূর্য থেকে উৎপন্ন ভূচৌম্বকীয় ঝড়ের সময়ে সর্বাধিক
মাত্রার বস্তুকণিকা পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ারে প্রবেশ করে। এ সময়ে সূর্য বিশাল আকারে
আয়নিত গ্যাস বা প্লাজমা উগড়ে দেয়, ফলে সৌরবায়ু পরিণত হয় সৌরঝড়ে। প্রচণ্ড বেগে উৎক্ষিপ্ত
হয়ে এই সৌরঝড় বিপুল পরিমাণ বস্তুকণিকাকে ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের দিকে ঠেলে দেয়। সূর্যের
গায়ে যেসব দাগ দেখা যায় সেগুলোকে বলে সৌরকলঙ্ক বা সানস্পট। এসব হচ্ছে সূর্যের বুকে
প্রচণ্ড অস্থিরতার চিহ্ন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সৌরকলঙ্কগুলোর চক্র ১১ বছরের। এ চক্রের
রয়েছে দুটি পর্ব। এগুলো হলো ঊধর্্বপর্ব বা সোলার ম্যাঙ্মাম এবং নিম্নপর্ব বা সোলার
মিনিমাম। সৌরকলঙ্কের একটি চক্রের শেষ থেকে আরেকটি চক্রের সূচনা পর্যন্ত মাঝখানের এ
সময়টি থাকে তুলনামূলকভাবে বেশ শান্ত। একেই বলে নিম্নপর্ব। এ পর্বে সৌরঝড় হয় ঠিকই কিন্তু
এর তীব্রতা থাকে অনেক কম। অপরদিকে ঊধর্্বপর্বে অর্থাৎ যখন সূর্যের বুকে অস্থিরতা সর্বোচ্চ
মাত্রায় থাকে তখন সৌরঝড়ের আশঙ্কা থাকে বেশি। ওই সময় সৌরঝড় হলে এর তীব্রতাও থাকে বেশি।
কেননা এ সময়ে আয়নিত গ্যাস বা প্লাজমার বিশাল এক প্রবাহ সূর্যপৃষ্ঠ থেকে লাফ দিয়ে একটি
বিশালকার নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রের মতোই পৃথিবীর দিকে ধাবিত হয়। কোনো কোনো সময় সেই
প্রচণ্ড প্রবাহে পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ার আলোড়িত ও সংকুচিত হয়ে যায়। এর ফলে ভয়াবহ
ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি মহাকাশের কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর সার্কিট জ্বলে যেতে পারে বা সেগুলো
কক্ষপথের বাইরেও চলে যেতে পারে। তাতে নভোচারীরা থাকলে কী হবে বুঝতেই পারছ। এরচেয়েও
ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে ওই বস্তুকণিকাগুলো যদি বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে তাহলে
কম্পাসের কাঁটা উল্টে যাবে। আমাদের বিদ্যুৎব্যবস্থা অচল হয়ে পড়বে। পৃথিবীর আবহাওয়ায়
পরিবর্তন ঘটে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। বেতার সংকেত আদান-প্রদানসহ সবরকম যোগাযোগ ব্যবস্থা,
বিশেষ করে টেলি যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ১৯৮৯ সালের সৌরঝড়ে
কানাডার কুইবেক প্রাদশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। স্বাভাবিক
অবস্থায় তা ফিরেয়ে আনতে দীর্ঘ সময় লাগে। এখানেই আশঙ্কার শেষ নয়। এই সৌরঝড়ের বছরগুলোতে
পৃথিবীর ওপরে সূর্যের পৃষ্ঠপান এতই বেড়ে যায় যে, এর প্রভাবে প্রবল ভূমিকম্পের আশঙ্কাকেও
একবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আশঙ্কা থাকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ পারমাণবিক বিপর্যয়েরও।
পৃথিবীর সব প্রাণীর শরীর আর মস্তিষ্কেও এর যথেষ্টই প্রভাব পড়ে। এর ফলে নিরীহ পশুপাখি
সাময়িকভাবে হিংস্র হয়ে ওঠে। স্বভাবগত হিংস্ররা হয়ে ওঠে অতিমাত্রায় হিংস্র । মানুষের
মধ্যেও সেসব প্রভাব দেখা যায়। সৌরঝড়ের প্রভাব ইদানীংকালে আরও বেশিমাত্রায় পৃথিবীর
বুকে আঘাত হানছে বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে
নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। কেননা, এটি এ সময়ের বহু চর্চিত বিষয়। একথা ঠিক, যত সময়
যাচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিংও তত বাড়ছে। সেই সঙ্গে মহাকাশের ওজোনস্তরের ফুটোও বড় হচ্ছে।
ওই ফুটো দিয়ে সবকিছুর পাশাপাশি সৌরঝড়ের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। এ তো গেল পৃথিবীর বুকে
সৌরঝড়ের প্রভাব। কিন্তু সূর্যের বুকে কী ঘটছে? সেখানকার অবস্থাও কিন্তু সুবিধাজনক
নয়। এ সৌরঝড়ের প্রভাবে সূর্যের নিজের উত্তাপও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, তা আটকানো অসম্ভব।
এরপর এর পরিণতি নিঃসন্দেহে মারাত্মক। কেননা নিকট ভবিষ্যতেই এ উত্তাপ এমন জায়গায় গিয়ে
পেঁৗছবে যে, তখন সূর্যে বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী। যার পরিণাম কী হবে তা ব্যাখ্যা করাই
বাহুল্য। তবে এটুকু বোধহয় বলাই যায়, শেষের সেই দিনগুলো হবে ভয়ঙ্কর। তাই এখন থেকেই ভাবতে
হবে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে। সচেতন হতে হবে সবাইকে।
সূত্র- বাংলাদেশপ্রতিদিন।
No comments:
Post a Comment