বীজ সহজলভ্য
'মাদার ড্রাগ' পপির ঝুঁকিতে দেশ
পপি
ফল মাদকের একটি ভয়ংকর উপাদান। ফলটি প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে আফিম, হেরোইন, অপিয়াম, মরফিন
ও প্যাথিডিনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য তৈরি করা হয়। এ কারণে পপি ফলকে মাদার
ড্রাগ বলা হয়। বাংলাদেশে পপির চাষ নিষিদ্ধ। এ ফসলের বীজ আমদানিও নিষিদ্ধ করেছে
সরকার। তবে \'পোস্তদানা\' নামে
মসলা হিসেবে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে পপিবীজ। ভারত থেকে সীমান্তের
চোরাই পথে ঢুকছে দেশে। প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে হাটবাজারে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তা বলছেন, পপিবীজ মাদকের
তালিকাভুক্ত না হওয়ার কারণে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে স্বস্তির
কথা হলো, যেসব বীজ চোরাই পথে দেশে আসছে সেগুলো সিদ্ধ করা।
তাই এসব বীজ অঙ্কুরোদ্গম নয় বা এর চাষ সম্ভব নয়। এমন স্বস্তি নিয়ে ঝিমিয়ে থাকা
ডিএনসি এবার এক ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে। গত বছর চালের নামে আমদানি করা ২৩ হাজার ৫০০
কেজি পপিবীজ আটক করে রাজধানীর কমলাপুর আইসিডি কাস্টম কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন ঘটনাটি
ধামাচাপা দিয়ে রাখার পর নথিপত্রই গায়েব করে ফেলেন আমদানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এক
বছর পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর ফাইল গায়েব হওয়ার ঘটনায় শাহজাহানপুর
থানায় মামলা করে
কাস্টম কর্তৃপক্ষ। মামলা হওয়ার পরও ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। গত
দুই মাসেও অভিযুক্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে
এক বছর কমলাপুর আইসিডিতে আটকে থাকা পপির বীজগুলো কী কারণে আনা হয়েছে এবং এর
অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা আছে কি না তাও নিশ্চিত হতে পারেনি প্রশাসন। ডিএনসির
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটক হওয়া পপি বীজের নমুনা সংগ্রহ করে
তাঁরা পরীক্ষার জন্য কৃষি বিভাগে পাঠিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পোস্তদানা নামে চোরাই পথে পপির বীজ অবাধে আসছে বাংলাদেশে। এ সুযোগে
বান্দরবানের থানচি, পানচিরিসহ পার্বত্য এলাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, নওগাঁসহ কিছু এলাকায় গোপনে চলছে পপির চাষ। বর্তমানে এনার্জি ড্রিংকস
তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে পপিবীজ ও পপি বল (ফল) থেকে প্রক্রিয়া করা উপাদান অপিয়াম।
ডিএনসির
পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, \'পপিবীজ আমাদের দেশে চাষ ও আমদানি দুটিই নিষিদ্ধ। চোরাই পথে মসলার আদলে
পপিবীজ সীমান্তবর্তী দেশ থেকে আসছে। বাজারে পোস্তদানা হিসেবে সবাই যে মসলাটি কিনে
খায় তা-ই পপিবীজ। ওই বীজ সেদ্ধ করা থাকে। পপির চাষের ব্যাপারে ডিএনসির নজরদারি
আছে। বিগত দিনে পার্বত্য এলাকায় পপির আবাদ ধ্বংস করা হয়েছে। এখন কোথাও চাষ হচ্ছে
বলে আমাদের জানা নেই।
ডিএনসির
কর্মকর্তারা জানান, পপির বল বা ফল পুরোটাই মাদকের
উপাদান। এ ফলের নির্যাস থেকে আফিম, হেরোইন, অপিয়াম, মরফিন, প্যাথিডিনসহ
ভয়ংকর সব মাদকদ্রব্য তৈরি হয়। বাংলাদেশে ওষুধ তৈরির জন্য দুটি প্রতিষ্ঠান পপির
কাঁচামাল প্যাথিডিন হাইড্রোক্লোরাইন ও মরফিন সালফেট আমদানি করে। এগুলো মরফিন ও
প্যাথিডিন চেতনানাশক হিসেবে অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত হয়। সূর্যমুখীর ফুলের মতো দেখতে
পপির ফুলের মাঝে গোল আকারের ফল হয়। পপির বল বা ওই ফল থেকে রস সংগ্রহ করে তৈরি হয়
ক্রুড আফিম। আফিম থেকে হয় মরফিন। মরফিন শুকিয়ে হয় হেরোইন। মরফিনের সঙ্গে একটি
উপাদানের সংমিশ্রণে হয় প্যাথিডিন। আফিমের রাসায়নিক মিশ্রণে তৈরি উপাদান হচ্ছে
অপিয়াম।
মসলা
হিসেবে আসছে দেদার : সূত্র জানায়, পপি ফল ও বীজ
বাংলাদেশে ডিএনসির তালিকায় প্রথম শ্রেণীর মাদক হেরোইন, আফিম
ও মরফিনের উপাদান। আইনের বলে, পপি চাষও বাংলাদেশে
নিষিদ্ধ। তাই পপির কাঁচা বা অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ আটক করার আইনগত
স্বীকৃতি আছে ডিএনসির। সেদ্ধ পোস্তদানা বা পপি সিড ডিএনসির নিয়ন্ত্রণ আওতার বাইরে।
তবে বাংলাদেশ সরকারের \'২০০৯-১২ আমদানিনীতি আদেশে\'
সব ধরনের পপিবীজ বা তাজা পোস্তদানা আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়।
ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক (ঢাকা অঞ্চল) আবু তালেব জানান, বাজারে
পোস্তদানা হিসেবে যে মসলা সবাই কিনে নিচ্ছে, তাও এখন
অবৈধভাবে আসে। এসব দানার মধ্যে কাঁচা দানা আছে কি না তা যাচাই করা কঠিন। এটি
পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেই। তবে দেশে এখন পপির চাষ হচ্ছে না বলে দাবি করেন
এই কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ভারতে এখন অনেক
এলাকায় পপির অনুমোদিত চাষ হচ্ছে। সেসব এলাকা থেকে চোরাই পথে পপি সিড দেশে আসছে।
বাংলাদেশের বাজারে পোস্তদানা মসলার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালে ডিএনসি বাজার থেকে বিভিন্ন
এনার্জি ড্রিংকসের নমুনা সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে ডিএনসি। ওই
পরীক্ষায় দেখা গেছে, ১০টি এনার্জি ড্রিংকসের মধ্যে মাদক
উপাদান অপিয়াম ব্যবহার করা হয়েছে। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক এনার্জি
ড্রিংকসের কারখানা ও গুদামে অভিযান চালায়। র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ
এম আনোয়ার পাশা কালের কণ্ঠকে জানান, র্যাবের ল্যাবে
পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাজারের কিছু ভেজাল এনার্জি
ড্রিংকসে অপিয়াম ও অপিয়ামের কাছাকাছি উপাদান অপিয়েট আছে। এমন এনার্জি ড্রিংকসের
সংখ্যা এখন বাড়ছে। দুই বছর ধরে অভিযান চালিয়ে অর্ধশত প্রতিষ্ঠান ও বিক্রেতাকে
জরিমানা করা হয়েছে। আনোয়ার পাশা আরো বলেন, \'সীমান্ত দিয়ে
পপি ফলের বীজের গুঁড়া নিয়ে আসে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এর ব্যাপক চাহিদা আছে। এসব
গুঁড়ার নির্যাস বা রসই অপিয়েট বা অপিয়াম।
অভিযুক্তরা
অধরা : সূত্র জানায়, গত বছরের ২ অক্টোবর কমলাপুর আইসিডিতে
পপি বীজের চালানটি আসে। পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের নামে
উন্নতমানের বাসমতি চালের নামে ওই পোস্তদানাগুলো আসে। চালানটির আমদানিকারক রাজধানীর
শান্তিনগরের ইস্টার্ন পাস শপিং কমপ্লেঙ্রে এবি এন্টারপ্রাইজ। আমদানিকারকের
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মিনার এজেন্সিজ (বাসা নম্বর-৬২১/এ)। তিনটি
কনটেইনার পরীক্ষায় পাওয়া যায় মাত্র ৫০০ কেজি চাল। বাকি ২৩ হাজার ৫০০ কেজি
উন্নতমানের পপিবীজ বা পোস্তদানা। মিথ্যা ঘোষণার অপরাধে শুল্ক আইনের ১৫৬ ধারায়
শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়ায় তা বিচারের জন্য পাঠানো হয় কমিশনারের কাছে। সংশ্লিষ্ট
দপ্তরে পৌঁছার আগেই মূল নথি গায়েব করে অভিযুক্ত চক্রটি। সম্প্রতি অবৈধ চালানটি
খালাস করতে প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে তদবির শুরু করা হয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর
পোস্তদানার চালানটি ফের শনাক্ত করে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। অভিযুক্তদের ব্যাপারে
শাহজাহানপুর থানায় মামলা করে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। বাদী কমলাপুর আইসিডি কাস্টমসের
সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম। মামলায় আসামি করা হয় আমদানিকারক মেসার্স এবি
এন্টারপ্রাইজ ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিনার এজেন্সিকে। সিলগালা সংবলিত নমুনা ও
ইনভেন্ট্রি রিপোর্টসহ নথিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও নথি
গায়েবের ঘটনায় সন্দেহজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে মামলা করার দুই মাস পরও আসামি
শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। মামলার বাদী নূরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে অনেকবার
চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, শাহজাহানপুর
থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তোফায়েল আহমেদ বলেন, \'মামলায়
মূলত নথিপত্র গায়েবের অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
এদিকে
এক মাস পর পপি বীজের চালানের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসি।
এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক (গোয়েন্দা, ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চল) মজিবুর রহমান পাটোয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন,
কাস্টমসের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করে কৃষি
অধিদপ্তরের গাজীপুরের বীজ পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। সেখানে বীজ তাজা বা
অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা আছে কি না তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ওই রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি।
ব্যাপক
চাষের আশঙ্কা : ডিএনসি সূত্র জানায়, ২০১০ সালে নওগাঁয়
প্রায় তিন একর জমিতে পপি আবাদ করে এক ভারতীয় নাগরিক। চাষিরা স্থানীয় লোকদের কাছে এ
ফসলটিকে বিশেষ জাতের সূর্যমুখী বলে পরিচয় করিয়ে দেন। জানাজানি হলে ডিএনসি পপি ফল
শনাক্ত করে। জানা যায়, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ওই চাষি পপিবীজ
নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনি নওগাঁ এলাকায় বিয়ে করেন। শ্বশুরবাড়ির পাশেই উর্বর জমিতে
অবৈধ চাষ শুরু করেন পপির। ওই চাষের ফলন ছিল অনেক ভালো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,
ওষুধ উৎপাদনের জন্য ভারতে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে পপির
চাষ করেন চাষিরা। বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে বেশি ও ভালো পপির ফলন হয় আফগানিস্তানে। এক
পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে উৎপাদিত পপিবীজ
আফগানিস্তানের চেয়ে উন্নতমানের। বাংলাদেশে বীজের সহজলভ্যতার সুযোগ নিয়ে দুর্গম
এলাকায় পপির চাষ করছে কিছু চক্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
বেশ কিছু পপির আবাদ নষ্ট করে। ২০০৬ সালে ঝিনাইদহে এবং পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েক শ
একর জমিতে পপি চাষের প্রমাণ পাওয়া যায়। বান্দরবানের ধানচি ও পানচিরিসহ দুর্গম
এলাকায় আবাদ নষ্ট করে সেনাবাহিনী। একাধিক সূত্র জানায়, এখানো
মিয়ানমার সীমান্তবর্তী দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ও বান্দরবানে ৫০ থেকে ৭০ একর জমিতে
উন্নতমানের পপি চাষ হচ্ছে। দুই দেশের সীমান্তবর্তী এসব দুর্গম এলাকায় সরকারের কোনো
নিয়ন্ত্রণ নেই।
No comments:
Post a Comment