স্টোনহেঞ্জ
(Stonehenge)
হাজার বছরের রহস্য
কম্পিউটারের
অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ এঙ্পিতে আমরা প্রায়ই একটা ওয়ালপেপার দেখি। নীল আকাশের
নিচে বিস্তীর্ণ ভূমিজুড়ে কতগুলো পাথর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। অনেকেরই জানা নেই
এই পাথরগুলো আসলে কী। এই পাথরগুলোকে বলে স্টোনহেঞ্জ। এটি নিওলিথিক এবং ব্রোঞ্জ
যুগের একটি স্তম্ভ। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে এটি
মানমন্দির হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আবার কারও কারও মতে, এটি
আসলে একটি বিশেষ স্মৃতিস্তম্ভ। আবার কতক গবেষক মনে করেন প্রাচীন যুগের একটি
কবরস্থান এটি। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানীরা জায়গাটি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত
নির্ভরযোগ্য কোনো তত্ত্ব বা প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। আর এ কারণেই হাজার বছর
ধরে পৃথিবীর মানুষের কাছে স্টোনহেঞ্জ এক অপার রহস্যের নাম। বিশাল সমতল ভূমিতে
খাড়া পাথরে তৈরি বিস্ময়কর এই স্থাপনার অবস্থান যুক্তরাজ্যের ওয়াল্টশায়ার কাউন্টিতে।
প্রায় চার হাজার বছর আগে তৈরি এই স্থাপনা নিয়ে পৃথিবীর বাতাসে এখনো উড়ে
বেড়াচ্ছে নানা প্রশ্ন। এই পাথুরে নিদর্শনের মানে কী? কারা
বানিয়েছে স্টোনহেঞ্জ? কেনই বা এমন বিচিত্র নকশায় তৈরি
হয়েছে এটি?
সমতল
ভূমি থেকে প্রায় ৮ মাইল উত্তরে অবস্থিত স্টোনহেঞ্জ। কতগুলো বড়
দণ্ডায়মান পাথর বৃত্তাকারে দাঁড় করানো। ১৩ ফুট
লম্বা ধূসর বেলে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে স্টোনহেঞ্জে। এটিকে মানুষের নিজের হাতে
তৈরি প্রাগৈতিহাসিক যুগের একমাত্র নিদর্শন মানা হয়। ১৩ ফুট লম্বা বেলে পাথরগুলোকে
প্রায় বৃত্তাকারে মাটিতে পুঁতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। সব পাথরের উচ্চতা
মোটামুটি সমান। সেগুলোর মাথায় লিনটেল বা আড়া ব্যবহার করে একটির সঙ্গে অন্য
পাথরটিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। লিনটেল হিসেবে ব্যবহৃত পাথরগুলোও বিশাল আকৃতির। এসব
তো বটেই পুরো স্টোনহেঞ্জের গঠনকে বেশ জটিলই বলা যায়। এর বাইরের দিকে একটি
বৃত্তাকার পরিখা রয়েছে। প্রবেশপথটির কিছুটা দূরেই রয়েছে মাটির বাঁধ। এ বাঁধের
ভেতর চতুর্দিকে বেষ্টন করে আছে ৫৬টি মাটির গহ্বর। পাথরগুলোর মধ্যে আরও দুই সারি
গর্ত বেষ্টন করে আছে। পাথরগুলোর গঠনের মধ্যে আছে দুটি বৃত্তাকার এবং দুটি ঘোড়ার
খুরের নলের আকারবিশিষ্ট পাথরের সারি। এ ছাড়াও কতগুলো পৃথক পাথর রয়েছে এখানে। তার
মধ্যে রয়েছে অলটার স্টোন বা পূজা বেদির পাথর ও শ্লটার স্টোন বা বধ্যভূমির পাথর।
এই স্তম্ভটি যারাই নির্মাণ করুক না কেন এর নির্মাণে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মানা
হয়েছে সেটি পরিষ্কার। ১৩ ফুট উচ্চতার পাথরগুলো সাজানোর রূপটিতে জ্যামিতিক
বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। ভালো করে লক্ষ করলে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার স্থাপত্যের সঙ্গে
এটির বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্থাপত্যের চারপাশজুড়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় বেশ
কিছু প্রাচীন কবর রয়েছে। গবেষকদের ধারণা, সব মিলিয়ে এখানে
প্রায় কয়েকশ কবর রয়েছে। নির্মাণশৈলীর এমন রহস্যময়তা ও বৈচিত্র্যের কারণে
মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্য তালিকায় স্টোনহেঞ্জের নাম রয়েছে। ৪০০০ বছর ধরে রোদ,
বৃষ্টি, ঝড়, তুষারপাত
সব উপেক্ষা করে এখনো সেই স্মারকটি তার নির্মাণের সব যন্ত্রপাতির চিহ্ন নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে।
যেহেতু
এটি চার হাজার বছর আগের একটি নিদর্শন, তাই স্বাভাবিক
কারণেই এটির ইতিহাস জানার জন্য মানুষের মধ্যে আগ্রহের কোনো কমতি ছিল না। বহু দেশের
বিজ্ঞানীরা বার বার সেলিসব্যারিতে গিয়ে স্টোনহেঞ্জ দেখে এসেছেন। নানাভাবে গবেষণা
করেছেন। তবু কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি কারা
স্টোনহেঞ্জের
নির্মাণ ও পরিকল্পনা করেছিল। তারা কোথাকার লোক ছিল। আর এই স্থাপত্যটিকে ঠিক কোন
সভ্যতার ছাপ মানা হবে এ নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। একেক সময় একেক গবেষক ও বিজ্ঞানী
একেক রকম মত দিয়েছেন। গত চার হাজার বছরের মধ্যে একটিও সর্বজনগ্রাহ্য মতামত
মেলেনি।
সপ্তদশ
শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ব্রিটেন ও গাল প্রদেশের সেলটিক
পুরোহিতরা ধর্ম-কর্ম করার জন্য স্টোনহেঞ্জ নির্মাণ করেছেন। এদের বলা হতো 'ড্রয়িড'। ড্রয়িডরা ছিল দারুণ রহস্যময়। এদের অনেক
অলৌকিক শক্তি ছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে ড্রয়িডদের সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের
কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। এসব ধর্মযাজক তাদের ধর্ম-কর্ম করার জন্য স্টোনহেঞ্জ তৈরি
করেছেন বলে সপ্তদশ শতকের বিজ্ঞানীরা জোর দাবি করেছেন। তখনকার বিখ্যাত
প্রত্নতত্ত্ববিদ ইনিগো জোন্স এই স্থাপনায় রোমান শিল্পকলার ছাপ খুঁজে পান। কিন্তু
আধুনিক যুগের প্রত্নতত্ত্ববিদরা এসব মানতে রাজি নন। তাদের ধারণা অনুসারে, সপ্তদশ শতাব্দীর এই তত্ত্বটি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা যে সময়
ড্রয়িড পুরোহিতরা বসবাস করতেন তার চেয়েও অন্তত হাজার বছর আগে স্টোনহেঞ্জ বানানো
হয়েছে। তাই ড্রয়িডরা প্রার্থনার জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন এমনটি ভাবার কোনো
কারণ নেই।
প্রত্নতত্ত্ববিদ
ইলিয়ট স্মিথ স্টোনহেঞ্জের নানাবিধ পরীক্ষা করে সেটিকে মিসরীয় স্থাপত্যশিল্পের
অবদান বলেছিলেন।
আবার
১৮০৮ সালে স্যার রিচার্ড কোল্ট বললেন অন্য কথা। তিনি স্টোনহেঞ্জের কাছাকাছি
কবরগুলোতে খননকার্য চালালেন। আর সেখানে মাটি খুঁড়ে তিনি খুঁজে পেলেন ব্রোঞ্জের
অস্ত্রশস্ত্র, সোনার অলঙ্কারসহ হাড়ের স্তূপ। আর এই আবিষ্কার
স্টোনহেঞ্জ সম্পর্কিত আরেকটি ধারণাকে নাড়া দিয়ে যায়। সেই ধারণা অনুসারে
স্টোনহেঞ্জ খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫০ শতকে পর পর তিনটি ভাগে নির্মিত হয়েছিল। প্রথম ভাগ
শেষে দ্বিতীয় ভাগ খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ শতকে, তৃতীয় বা শেষ
ভাগ খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০ শতকে। প্রাপ্ত সব দ্রব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিশেষজ্ঞরা
বলেন, এটি বহিরাগতদের নির্মিত একটি স্থাপনা। তবে এ নিয়েও
বিতর্ক রয়েছে।
আবার
কারও কারও মতে, মাইসিনে যোদ্ধারা স্থানীয়
বাসিন্দাদের দিয়ে স্টোনহেঞ্জ তৈরি করেছে। কিন্তু এই যুক্তি ধোপে টেকেনি। কারণ
কার্বন-১৪ ডেটিং পদ্ধতি দিয়ে প্রমাণিত হয়, স্টোনহেঞ্জ
মাইসেনিয়ান যুদ্ধেরও প্রায় ৫০০ বছর আগে তৈরি হয়েছে।
স্টোনহেঞ্জের
নির্মাতা, নির্মাণের উপকরণ এবং নির্মাণকাল নিয়ে যেমন বিতর্কের
শেষ নেই, তেমনি রহস্যের শেষ নেই এর কার্যকারণ নিয়েও।
বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন ঠিক কী কারণে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বিখ্যাত
ব্রিটিশ পণ্ডিত উইলিয়াম স্টাকলে তার বিখ্যাত এক বইয়ে স্টোনহেঞ্জকে গ্রীষ্মকালীন
সূর্যোদয়ের মানমন্দির বলেছেন।
প্রায়
এ মতকেই সমর্থন করেছেন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ডিউক। তার মতে, সেলিসব্যারিতে নির্মিত স্তম্ভগুলো একত্রে একটি সৌরমণ্ডলের রূপ পরিগ্রহ
করে। দক্ষিণ ইংল্যান্ডের অনেক জায়গায়ই এ ধরনের রহস্যময় পাথরখণ্ড রয়েছে। এর
অধিকাংশ পাথরকেই আকাশমুখো করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আর এগুলোকেই একসঙ্গে একটি
পূর্ণাঙ্গ সৌরমণ্ডল বলেছেন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড। তার মতে, এখানে
একেকটি স্থাপত্য একেকটি গ্রহের অবস্থান নির্দেশ করছে। এর মধ্যে আমাদের আলোচিত
স্থাপত্য স্টোনহেঞ্জ শনি গ্রহের স্থান নির্দেশ করছে।
মজার
ব্যাপার হলো, ১৯৬৩ সালে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিখ্যাত
জ্যোতির্বিদ জেরাল এস হকিন্স ও স্যার নর্মান লকিয়ার স্টোনহেঞ্জকে বিশেষ এক ধরনের
কম্পিউটার হিসেবে অভিহিত করেন। তাদের মতে, বিশেষ
কম্পিউটার স্টোনহেঞ্জ দিয়ে সূর্যের অবস্থান, গ্রহ-নক্ষত্রের
গতিপথ ইত্যাদি নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হতো।
বহু
বিশেষজ্ঞ স্টোনহেঞ্জকে প্রাচীন জাদুর কেন্দ্রস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ২০০৮
সালে প্রত্নতাত্তি্বকরা এটিকে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সমাধিস্থল বলে দাবি করেন।
তাদের মতে, খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে এর প্রথম খননকাজ
শুরু হয়। এর পর থেকে ৫০০ বছর ধরে এখানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও সমাধিকরণ প্রক্রিয়া
চলে আসছে। স্টোনহেঞ্জ যেখানে তৈরি করা হয়েছে, তার থেকে
প্রায় দুই মাইল দূরে স্টেডিয়ামের মতো আকৃতির আরও দুটি স্থাপনা পাওয়া গেছে। এ
দুটো কাঠের তৈরি। এগুলো কোন কাজে ব্যবহৃত হতো কিংবা এর সঙ্গে স্টোনহেঞ্জের কোনো
সম্পর্ক রয়েছে কিনা এ সম্পর্কেও কোনো তথ্য বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত দিতে পারেননি।
স্টোনহেঞ্জ নিয়ে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের এই যে মতভেদ ও বিতর্ক সেটিই একে অনন্য
করে তুলেছে। করে তুলেছে আরও বেশি রহস্যমণ্ডিত। তবে যারাই যে উদ্দেশ্যে এটিকে
বানিয়ে থাকুন না কেন, কোনো না কোনো উদ্দেশ্য হয়তো ছিল।
সে উদ্দেশ্য সফল হোক বা না হোক অনন্য ও রহস্যময় একটি স্থাপত্য হিসেবে ইতিহাসের
পাতায় এটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর স্থাপত্য হিসেবে অনন্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ
১৯৮৬ সালে ইউনেসকো একে 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট' হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সুত্র- বাংলাদেশপ্রতিদিন
No comments:
Post a Comment