NEWS

বাংলায় তুলি প্রযুক্তির সুর

15 Oct 2012

১০ কোটি টাকার জাল নোট


 ১০ কোটি টাকার জাল নোট ও নোট তৈরির সরঞ্জামসহ বাংলাদেশে জাল টাকা তৈরির প্রবর্তক দুরুজ্জামান ওরফে নুরুজ্জামান ওরফে জামান বিশ্বাস (৫০)সহ জালিয়াত চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। জামান বিশ্বাস নিজেকে আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা
লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলে দাবি করেছে। তার কাছে এ সংক্রান্ত ভিজিটিং কার্ডও পাওয়া গেছে। চক্রের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে ৩ জন নারী সদস্য। ডিবির এডিসি মশিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন একটি গোয়েন্দা দল শনিবার দুপুর থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সময়ে অভিযান চালিয়ে ডেমরা ও কামরাঙ্গীর চর থেকে এদের গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশী ও ভারতীয় জাল নোট ছাড়াও টাকা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। আবিষ্কার করা হয় জাল টাকা তৈরি দুটি কারখানা। বাংলাদেশে জাল টাকা তৈরির মূল হোতা জামান বিশ্বাস ছাড়াও অন্য যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা হলেন- জালাল উদ্দিন (২৫), শান্তা ওরফে শাবানা (২৫), মোছাম্মৎ মাকসুদা (২০)লিমা আক্তার (২০), রহমান (৩৬), খালিদুজ্জামান (৩৫), বাবু মিয়া ওরফে তোতলা বাবু, সুজন ওরফে ডেসটিনি সুজন (২৭) এবং মঞ্জুরুল কামাল ওরফে কামাল মাস্টার (৬০)। ডিবি পুলিশ দাবি করেছে, স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জাল টাকার চালান এটি। গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে নগদ ২ কোটি ৫০ লাখ ২২ হাজার বাংলাদেশী জাল টাকা, ৮৮ হাজার ভারতীয় জাল রুপি, প্রায় ৮ কোটি টাকার রেডি মেটেরিয়ালস উদ্ধার করা হয়। রেডি মেটেরিয়ালসের মধ্যে রয়েছে- একটি ফ্লোরা ডেস্কটপ, একটি স্যামসন মনিটর, ৩টি ল্যাপটপ, ৬টি ইপসন প্রিন্টার, ইপসন প্রিন্টারের বিভিন্ন রঙের ১২ হাজার কার্টিস, বাংলাদেশ ব্যাংকের জলছাপ, বঙ্গবন্ধুর ছবির জলছাপ প্রিন্ট করার স্ক্যান, বাংলাদেশ ব্যাংক, ২ ব্যাগ নিরাপত্তা সুতা, বিভিন্ন রকমের ৫৭টি বোর্ড, স্ক্যান প্রিন্টের রং টানার ৬০টি রাবার, জাল টাকা ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত নেগেটিভ, ৬০টি কাটার ব্লেট, বিভিন্ন ধরনের রঙের ১২০টি কৌটা, ফেবিকল এপ্রিটন ব্যান্ডের ৭৫ কৌটা আঁঠা, ২২ বোতল তরল রিডিউচার, ৩০ বোতল বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল, ৩৫টি স্টিলের স্কেল, ২৭টি বিভিন্ন ধরনের আর্ট ব্রাশ, বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়ান মুদ্রার ২টি ডাইস। এছাড়া এদের কাছ থেকে ডাইস, বঙ্গবন্ধু, শাপলা, বাংলাদেশ ব্যাংক, ১০০০ ও ৫০০ টাকার জলছাপ সম্বলিত কাগজ ৪০ প্যাকেট, ৫টি হাতুড়ি, ৫টি প্লাস, টাকা কাটার ১টি স্কেল মেশিন, নিরাপত্তা সুতা বানানোর ১টি ফয়েল পেপার রোলসহ বিপুল পরিমাণ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ডিবি (পশ্চিম)-এর ডিসি মাহবুবুর রহমান জানান, প্রথমে ডেমরার বাঁশেরপুলস্থ ফরমান খাঁ মার্কেটের পাশে ৩১ আমীনবাগের একটি বাসার ৫ম তলায় অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ৩০ লাখ জাল টাকা ও প্রায় ৫ কোটি টাকার জাল নোট তৈরির সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় জাল নোট তৈরি বিক্রির অন্যতম হোতা লিয়াকত হোসেন ওরফে জাকির মাস্টার এ কারখানার অন্যতম মালিক। সে তার সহযোগী জালাল, শান্তা ও অন্যদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর ও ডেমরার বিভিন্ন এলাকায় বাসাভাড়া নিয়ে জাল টাকার ব্যবসা করে আসছিল। শান্তা ওরফে শাবানা তার অন্যতম কারিগর। সে জাল টাকা তৈরির বিশেষ ধরনের মূল কাগজ (যাতে বিভিন্ন রকমের জলছাপ এবং নিরাপত্তা সুতা ছাপ লাগানো থাকে) বানাতো। পবিত্র ঈদু আজহা উপলক্ষে এ চক্র আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল বলে গ্রেপ্তারকৃতরা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে প্রথমিকভাবে স্বীকার করেছে। এরই মধ্যে তারা ২ কোটি টাকার জাল নোট বাজারে ছেড়েছে। জাকির মাস্টার ও তার সহযোগীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কামরাঙ্গীরচরের পশ্চিম রসুলপুরের একটি ৫ম তলা বিশিষ্ট বাড়ির ২য় তলায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে ৮৮ হাজার জাল ভারতীয় রুপি, ১ কোটি ২০ লাখ ২২ হাজার জাল টাকা, ৩ কোটি  জাল টাকা তৈরির উপকরণসহ জামান বিশ্বাস, তার আপন ছোটভাই এডভোকেট খালেদুজ্জামান ও অন্য সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হয়। জামান বিশ্বাস কুষ্টিয়া এবং ফরিদপুর এলাকায় সারা বছর জাল টাকার ব্যবসা করলেও ঈদ উপলক্ষে চলতি মাসের শুরুতে জাল টাকার অন্যতম পাইকার কামাল মাস্টারের কামরাঙ্গীচরের বাসায় এসে জাল টাকা তৈরি শুরু করে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- জামান বিশ্বাস (৫০) বাংলাদেশে জাল টাকার সূচনা করে। প্রথম জীবনে সে রাজশাহীতে আকবর নামের এক ব্যক্তির (বাড়ি নওগাঁ) নঙ্গে আর্ট করতো। ১৯৯৮ সালে একদিন আকবর তাকে একটি সাদা কালো ১০০ টাকার (ফটোকপি করা) নোট কালার করার জন্য বললে সে তা করে দেয়। তখন থেকে তার মনে জাল টাকা তৈরির চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। ৯৯ সালের প্রথম দিকে সে রাজধানীর জিগাতলায় বাসা ভাড়া করে। প্রায় ৮০ টাকা দিয়ে একটি কালার ফটোকপি মেশিন কিনে। প্রথমে কালার ফটোকপি দিয়ে নোটের উভয় পাশ ফটোকপি করার পর স্ক্যান প্রিন্টের মাধ্যমে তাতে বাঘের মাথার জলছাপ দেয়। ফয়েল কাগজে হিট দিয়ে সিকিউরিটি সুতা বসায়। তখন প্রতি লাখ (পাঁচ শটাকা ২ বান্ডিল) জাল টাকা ১০-১২ হাজার টাকায় বিক্রি করতো। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জাল টাকা বিক্রেতা হেলালকে হাতেনাতে ধরে। হেলালের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ডিবি পুলিশ তখন জামানকে কালার ফটোকপি মেশিন ও জাল টাকাসহ গ্রেপ্তার করে। ২১ মাস জেল খাটার পর জামাল জামিনে বের হয়। পরে কম্পিউটার, কালার প্রিন্টার এবং বিভিন্ন রকমের কেমিক্যাল ব্যবহার করে ঘরোয়া কারখানা স্থাপন করে ব্যাপকভাবে জাল টাকার বাণিজ্য শুরু করে। প্রথমদিকে ছগীর মাস্টার, হুমায়ুন, রাশিদুল, কাওছার, জাকির, আবদুর হামিদ, সেলিম, ঈমন, এবং সুমনসহ অনেকে জামান বিশ্বাসের কাছ থেকে নিয়মিত জাল টাকা পাইকারিভাবে কিনতো। পরে জামান বিশ্বাসের কাছ থেকে জাল টাকার দীক্ষা নিয়ে নিজেরাই জাল টাকা তৈরি শুরু করেন। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে ডেমরা ও কামরাঙ্গীরচর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক ২টি মামলা করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের রিমান্ডে আনা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, রাজধানীতে জাল টাকার কারবারীদের ৮-১০টি চক্র সব সময় সক্রিয় থাকে। ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে এ চক্রের সংখ্যা বেড়ে যায়। জাল টাকা প্রতিরোধে কোরবানির পশুর হাট ও শপিং মলগুলোতে বিশেষ ধরনের মেশিন বসানো হচ্ছে। তিনি জানান, জামান বিশ্বাস ভারতে গিয়ে ভারতীয় জাল মুদ্রা সরবরাহ করে। এরই মধ্যে সে ১০-১২ বার ভারত গিয়েছে।
নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করে জামান বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানায়, আমি ১০-১২ বছর ধরে জাল টাকা তৈরি করে আসছি। আমার কাছ থেকে পাইকারি ধরে জাল টাকা কিনে অনেকেই কারখানার মালিক হয়েছে। অনেক সম্পদ অর্জন করেছে। আমি তেমন কিছু করতে পারিনি। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শিখিয়েছি। ভালভাবে চলেছি। তিনি জানান, একেক সময় একেক ডিলারের কাছে টাকা সরবরাহ করেছি। এ পর্যন্ত ২০-৩০ কোটি টাকা বাজারে ছেড়েছি। তিনি জানান, ৪-৫টি হাত বদলের পর টাকা সাধারণ মানুষের হাতে জাল টাকা পৌঁছে। আমি ডিলারদের কাছ থেকে প্রতি লাখে ৬-৭ হাজার টাকা নিই। ডিলাররা জাল টাকা প্রতি লাখে ১০-১২ হাজার টাকা করে বিক্রি করে। তিনি জানান, আমি কখনও ভারতে গিয়ে জাল মুদ্রা সরবরাহ করিনি। ভারত থেকে উত্তম কুমার নামক এক ব্যক্তি এসে আমার কাছ থেকে জাল রুপি নিয়ে সেখানে ব্যবসা করে। তিনি জানান, আমার কাছে যে ধরনের মেশিন আছে তাতে যে কোন দেশের মুদ্রা নকল করতে পারবো। তবে আমেরিকান মুদ্রা নকল করতে পারবো না। কারণ, ওই টাকা এমনভাবে তৈরি যে ভালভাবে স্ক্যানিং করা যায় না। এর আগে ভুটান ও মিয়ানমারসহ অনেক দেশের মুদ্রা জাল করেছি। গ্রেপ্তারকৃত খালিদুজ্জামান জানায়, আমি রাজশাহী ল কলেজে ওকালতি পড়ছি। জামান বিশ্বাস আমার আপন ভাই। ভাইয়ের হাত ধরেই এ পেশায় এসেছি। শান্তা ওরফে শাবানা বলে, স্বামী সিরাজুলের হাত ধরেই জাল টাকায় জলছাপের কাজ শিখেছি। আমরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর স্বামী পলাতক।

সুত্রঃ বিডি নিউজ

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad