NEWS

বাংলায় তুলি প্রযুক্তির সুর

21 Sept 2012

আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় রহস্য


আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় রহস্য
ক্রপ সার্কেল

একবার ভাবুন মাইলের পর মাইলজুড়ে ফসলের ক্ষেত। রাতে ঘুমাতে গেলেন সাধারণভাবে। পরদিন সকালে দাঁত ব্রাশ করতে করতে ওয়াচ টাওয়ারে গেলেন ফসলের ক্ষেতটা একনজর দেখার জন্য। তাকাতেই আপনার চক্ষু চড়কগাছ। ওমা এ কি! মাইলের পর মাইল আপনার শস্যক্ষেতে কিসব বিচিত্র নকশা চোখে পড়ছে! নকশা করার জায়গাটা ব্যতিরেকে ফসলের বাকি অংশটুকু ঠিকই আছে। শস্যক্ষেতের এই বিচিত্র নকশার নামই ক্রপ সার্কেল। ক্রপ সার্কেল। বাংলায় শস্যবৃত্ত। অর্থাৎ শস্যের ওপর অাঁকা নকশা বা চিত্র। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও বাস্তবের জিনিসটি তার চেয়েও বেশি অদ্ভুতুড়ে। আর এই জিনিসটি আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে রহস্য।

হুট করে ভাবলে বিষয়টি গাঁজাখোরি মনে হতে পারে। মনে হতে পারে এ আবার কিভাবে সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। যদি শস্যক্ষেত হয় বিস্তীর্ণ বা বিশাল এলাকাজুড়ে আর এই নকশা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বিরল কোনো জ্ঞান, তাহলে অসম্ভব কেন হবে? অধিকাংশের ধারণা, এই সুবিশাল একেকটি ক্রপসার্কেল তৈরিতে এলিয়েন বা ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নইলে এরকম জটিল ধরনের নিপুণ জ্যামিতিক চিত্র মানুষ কি করে অাঁকবে? কিছু কিছু ক্রপ সার্কেলের রিপ্লেকা তৈরির চেষ্টা করেছিল অনেকেই। কিন্তু মূল ক্রপ সার্কেলের কাছাকাছিও পেঁৗছতে পারেনি সেগুলো। এর পেছনে মূল কারণ হলো আসল ক্রপ সার্কেলগুলোতে যে গাণিতিক জ্ঞান ও জ্যামিতিক প্যাটার্নের প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে, এর কাছাকাছিও পেঁৗছতে পারেনি মানুষের তৈরি ক্রপ সার্কেলগুলো। এ ধরনের ক্রপসার্কেল তৈরি করতে হলে একজন মানুষকে গণিত এবং জ্যামিতি সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, সেই জ্ঞানের পরিচয় রেখে বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেতে ফুটিয়ে তুলতে হবে তার চিন্তার বাস্তব প্রতিবিম্ব। যা প্রায় অসম্ভব। ১৯৭০ সালের দিকে প্রথমবারের মতো এ ধরনের আবিষ্কারের কথা শোনা যায়। চারদিকে ব্যাপক হৈচৈ ওঠে। কেউ কেউ আবার এটিকে স্রেফ একটি পাবলিসিটি স্টান্ট বলে উড়িয়ে দিতে চাইল। তবে কৌতূহলী বিজ্ঞানীরা থেমে যাননি। তারা রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। থেমে থাকেনি ক্রপ সার্কেল আবিষ্কারও। এর পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই নতুন নতুন ক্রপ সার্কেল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আর এর প্রতিটিই আগের চেয়ে বেশি জটিল, নিখুঁত এবং নান্দনিক। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ক্রপ সার্কেল আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে আবার কোনোটিতে বিচিত্র ভিনগ্রহের প্রাণীর মুখচ্ছবি অাঁকাও পাওয়া গেছে। তবে কি এসব ভিনগ্রহের প্রাণীদেরই কাজ? নইলে কারা, কেন তৈরি করছে এগুলো। এর রহস্যটাই বা কি?

ক্রপ সার্কেলের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। মাত্র বছর চলি্লশেক আগের ঘটনা। ১৯৭০ সালের দিকে প্রথম এ ধরনের নকশা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ফসল মাড়িয়ে নিয়ে এই নকশা তৈরি করা হয়। তবে সমস্যা হলো এইসব শস্য চক্রের শিল্পীদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। জানা যায়নি কী উদ্দেশ্যে কোন প্রতিভাবানরা এমন নকশা এঁকেছেন। প্রথম দিকে ফসলের মাঝে কাটা এই নকশাগুলো সোজা সরল জ্যামিতির প্যাটার্ন এ হতো। যেমন সাধারণ বৃত্ত, চৌকানা বাঙ্ এসবের মতো। তবে দিন যতো গড়াতে থাকলো, শস্যচক্রগুলো ততোই জটিল হতে থাকলো। অনেকের মতে ক্রপ সার্কেল হয়তো আরো আগে থেকেই ছিল কিন্তু ঐভাবে নজরে আসেনি। তখনকার সময়ের ক্রপ সার্কেলকে বলা হতো 'মোয়িং ডেভিল' বা ফসল কাটুনে শয়তান। ১৬৭৮ সালের ঘটনা। সেই সময়কার বিলেতের একটি বুলেটিনে বিশেষ একটি কার্টুন ছাপা হলো। কার্টুনটিতে ফসলের মাঠে এরকম নকশা করা দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়। যেটির মূল উদ্দেশ্য ছিল কেউ ফসল ধ্বংস করছে এমনটি প্রমাণ করা। আলোচিত সেই কার্টুনটির শিরোনাম ছিল ফসল ফসল কাটুনি শয়তান। বুলেটিনে দাবি করা হয় বার্লি বা যবের দিগন্তজোড়া ক্ষেতের ভেতর কে যেন বিশালাকৃতির বৃত্তাকার গর্ত তৈরি করছে। ঠিক গর্ত নয় বরং খুব নিখুঁত ও সাবধানতার সঙ্গে যব গাছের আগাগুলো কাটা হয়েছে। আর এই কাজটি এমনভাবে করা হয়েছে যা কোনো মানুষের কাজ বলে মনে হয় না একদমই। বুলেটিনে এক কৃষক দাবি করেছেন এটি কোনো শয়তানের কাজ। ফসল কাটুনে অশুভ শয়তান। গভীর রাতে এই অশুভ শয়তান এসে যব গাছের আগা কেটে নিয়ে গেছে। পৃথিবীজুড়ে এরকম হাজারো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে যার সঙ্গে আজকের আধুনিক ক্রপ সার্কেলের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। আশ্চর্যের বিষয় আজ যেমন আমরা ক্রপ সার্কেলের রহস্য নিরূপণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি, ঠিক তেমনি হাজার বছর ধরে ক্রপ সার্কেলকে এরকম অলৌকিক কোনো বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো বাদ দিলে ১৯৭০ সালের দিকে বিশ্বমিডিয়ায় প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসে ক্রপ সার্কেল। একাধিকবার দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠে মাইলের পর মাইল এলাকাজুড়ে বিচিত্র সব নকশা দেখা যায়। বিশেষ করে ভুট্টা, গম বা বার্লি গাছ মাড়িয়ে বা গুটিয়ে এ ধরনের নকশা তৈরি করা হতো। প্রথমদিকে বিজ্ঞানী ও অনেক সচেতন মানুষজন দাবি করেন এই নকশাগুলো আসলে মানুষেরই তৈরি। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তৈরি করা হয় এগুলো। কিন্তু রহস্যের জন্ম হলো তখনই যখন এইসব ফসলের ক্ষেতের সঙ্গে জড়িত প্রায় সব কৃষক দাবি করলো এগুলো কোনোভাবেই মানুষের তৈরি নয়। মানুষের পক্ষে এরকম নকশা তৈরি কোনোমতেই সম্ভব নয়। তারচেয়েও বড় বিষয় মাত্র এক রাতে এতো বড় নিখুঁত নকশা তৈরি করা মানুষের পক্ষে আসলেই কঠিন।

বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা গেছে ১৯৭০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি দেশে এ ধরনের ক্রপ সার্কেল বা বিচিত্র আকৃতির নকশা দেখা গেছে। সে হিসেবে বিশ্বে এখনও পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি ক্রপ সার্কেল দেখা গেছে। তবে একটি আশ্চর্যের বিষয় হলো এইসব ক্রপসার্কেলের অধিকাংশের দেখাই মিলেছে ইংল্যাণ্ডে। এছাড়াও আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ায় নানান সময়ে ক্রপ সার্কেল দেখা গেছে। অধিকাংশ বললে বোধ হয় ভুল বলা হবে। বলা চলে প্রায় ৯০ ভাগেরও বেশি ক্রপ সার্কেলেরর দেখা মিলেছে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে। জ্যামিতিক, গাণিতিক নিখুঁত নকশার বাইরে ক্রপ সার্কেলের ক্ষেত্রে আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিটি নকশাই খুব প্রাচীন কোনো নিদর্শনের কাছাকাছি আঁকা। যেমন স্টোনহেঞ্জ, এভেবরী কিংবা শীলবরী হিল। আর এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্রপ সার্কেল দেখা যায় দক্ষিণ ইংল্যাণ্ডের স্টোনহেঞ্জ এর কাছে। এই স্টোনহেঞ্জের জন্মরহস্য নিয়েও বিজ্ঞানীদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। অনেক বিজ্ঞানীদের মতে বিশাল এই পাথুরে মূর্তিগুলো কোনো না কোনো ভিনগ্রহের প্রাণীর তৈরি। আর সেই স্টোনহেঞ্জের কাছাকাছি নিয়মিত ক্রপ সার্কেলের উপস্থিতি কী সত্যি ভিনগ্রহীদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য?

কৃষকদের দাবিও অনেকটা এরকমই। এদের অনেকেই নাকি ভোরবেলা ফসলের ক্ষেতের ওপর বিচিত্র আকৃতির উড়োজাহাজ উড়তে দেখেছেন। অল্প সময় প্রদক্ষিণের পরই যেটি হাওয়ায় মিশে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন চোখের সামনেই কী এক অলৌকিকত্বের প্রভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ক্রপ সার্কেল তৈরি হওয়া শুরু হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একটি ক্রপ সার্কেল তৈরি শেষ হয়ে যায়। আবার অনেকে ক্রপ সার্কেলের আশেপাশে মাত্রাতিরিক্ত রেডিয়েশনের উপস্থিতির কথা বলে থাকেন। রেডিয়েশনের উপস্থিতি ইউএফও বা ফ্লাইং সসারের উপস্থিতির পক্ষে জোরালো প্রমাণ রাখতে পারে। কিন্তু ক্রপ সার্কেলের পাশে মাত্রাতিরিক্ত রেডিয়েশনের উপস্থিতির জোরালো প্রমাণ এখনো খুজে পাওয়া যায়নি। তাই রহস্য থেকেই যাচ্ছে।

তবে আরেক দল মানুষ ক্রপ সার্কেলকে কোনো অলৌকিক ঘটনা বা ভিনগ্রহীদের সংকেত হিসেবে মানতে রাজি নন মোটেই। তাদের মতে একদল মানুষ কয়েক ঘন্টা চেষ্টা করলেই তৈরি করতে পারে নিখুঁত ও জটিল একটা ফসলি নকশা। এ চেষ্ট যে একেবারে করা হয়নি তা নয়। অনেকেই ক্রপ সার্কেল তৈরি করেছেন। কিন্তু সেগুলোর তুলনায় রহস্যেঘেরা ক্রপসার্কেলগুলো অনেক জটিল ও নরান্দনিক প্যাটার্ণের। আর সেগুলো নিখুঁতও বটে। তার চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো বর্তমান পৃথিবীর নানা দেশের শিল্পীরা ফসলের মাঠে ক্রপ সার্কেল তৈরি করে থাকেন। এটা এখন ইন্টারেস্টিং একটা শিল্পমাধ্যমও বটে। বর্তমান সময়ে ক্রপ সার্কেলকে বৃহদাকার জ্যামিতিক শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। এরকম দু'জন শিল্পী হলেনডগ বুয়ার এবং ডেভ চার্লি। তারা তাদের তৈরি একটি বৃহদাকার ক্রপ সার্কেলকে অলৌকিক বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আর এই অপকর্মের জন্য ১৯৯২ সালে তারা এগ নোবেল [কুখ্যাতির জন্য সেরা পুরষ্কার] এ ভূষিত হন।

আবার আরেকদল মানুষের দাবি ঝড়ো বাতাস, টর্নেডোর সময়ও বাতাসের বিন্যাসে এরকম ক্রপ সার্কেল তৈরি হতে পারে।

তবে ক্রপ সার্কেল তৈরির উপর অনেক রকম তথ্য আছে। কিন্তু এর কোনোটিই সন্তোষজনক নয়। আবার এ বিষয়ক বেশ কিছু জোরালো প্রমাণ আছে ভিডিও রূপে। যেখানে দেখা যায় কিছু ছোট, উজ্জ্বল সাদা লাইটের গোলা ক্রপ সার্কেলের আশেপাশে প্রদক্ষিণ করছে। এইসব ভিডিওর দুয়েকটি আবার প্রকাশ্য দিবালোকে তোলা। আর ঐ বস্তুগুলিকে মনে হয় কোনো উদ্দেশ্য ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। ক্রপ সার্কেল তৈরি এবং ঐ লাইটের গোলার মধ্যে একটা যোগাযোগ হয়তো অবশ্যই আছে। ক্রপ সার্কেল থেকে নেওয়া গাছের নমুনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয় হরহামেশাই। বহুদিন থেকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত একজন বিজ্ঞানী। তিনি মার্কিন বায়োফিজিসিস্ট ড. উলিয়াম লেভেনগুড। তিনি মনে করেন ক্রপ সার্কেল তৈরিতে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের হাত আছে। ক্রপ সার্কেল রিসার্চারদের ক্রমাগত বলা হয় তারা যেন নিত্যনতুন পদ্ধতিতে ও অভিনব চিন্তাধারায় অনুসন্ধান করে। এখন এই রিসার্চের ক্ষেত্রে মেডিটেশন, লাইট ও সঙ্গীত ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে নতুন নকশার মানে বোঝা যায় এবং ক্রপ সার্কেল গুলি থেকে মনে হয় মানুষের মনের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।

শস্যচক্র বা ক্রপ সার্কেল নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। এই বিতর্ক হয়তো শেষ হবে না কখনোই। এরপরও বিশ্বজুড়ে যখন ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধানে কোটি কোটি ডলার খরচ করে চালানো হচ্ছে বিপুল গবেষণা, তখন কৌতুহলী মন প্রশ্ন তুলতেই পারে ভিনগ্রহীরা আবার এরকম কোনো কিছু তৈরি করে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে নাতো? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু ক্রপ সার্কেলের রহস্য আজো সমাধা হয়নি।

 Posted by..: Fahad hossain.

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad